বিশ্বের বুকে বড় কোম্পানি হিসেবে দাঁড়াতে চাই

বিশ্বের বুকে বড় কোম্পানি হিসেবে দাঁড়াতে চাই

Published on: 21st April, 2022

প্রয়াত শিল্পপতি মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত প্রাণ-আরএফএল গ্রুপকে এখন বহুজাতিক কোম্পানিতে পরিণত করতে চান প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী  আহসান খান চৌধুরী। তিনি জানালেন, বিশ্বের ১৪৫ দেশে এখন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই রপ্তানি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে পরিণত হবে। আগামীতে ১০ দেশে কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের। আর দেশের অর্থনীতিতেও প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে চান খ্যাতনামা এই শিল্প উদ্যোক্তা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রুহুল আমিন রাসেল ও সাইফ ইমন। ছবি- জয়ীতা রায়

বাংলাদেশ প্রতিদিন : প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বর্তমান চিত্র ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা কী?

আহসান খান চৌধুরী : করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জ কিন্তু অনেক বেশি। এটাও সত্যি যে, ব্যবসায়িক সুযোগও অনেক বেশি। আমাদের পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। লোকাল ব্যবসাও বাড়ছে। মানুষ আমাদের আরও অনেক বেশি গ্রহণ করছে। তাই আমরা ভীষণভাবে আশাবাদী। অন্যদিকে আমরা রপ্তানির ক্ষেত্রে আরও বেশি আশাবাদী। সেই সঙ্গে আমাদের আশার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে আমাদের কাজে। আগামী দিনে নতুন নতুন পণ্যের সম্ভার আমরা বাজারে নিয়ে আসব। আধুনিক বিশ্বে খাদ্য এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে যে ছোঁয়া, যেটা বাংলাদেশের ভোক্তার চাহিদা আমাদের কাছে প্রেরণ করেছেন, এই চাহিদার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করে যাব আমরা। পৃথিবী কেবল উচ্চ আয়ের মানুষের জন্য নয়। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্যও এই পৃথিবী। যাতে সুন্দরভাবে প্রকাশিত হতে পারি, সেই ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। এই দায়িত্বকে সামনে রেখে আমরা স্থানীয় বাজার ও বৈশ্বিক বাজারে কাজ করছি। পৃথিবীর অনেক বহুজাতিক সুপার মার্কেট আমাদের পণ্য গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বৈশ্বিক বাজারে আপনার বিনিয়োগ পরিকল্পনা কী?

আহসান খান চৌধুরী : আজকের দিনে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো পুঁজি। বিগত দিনে দেখবেন আমরা আমাদের পুঁজিকে বিলাসিতায় ব্যয় না করে, আমরা সব সময় পুনরায় বিনিয়োগ করেছি। গত ৪১ বছরের প্রাণ-আরএফএলের প্রতিটি পুঁজি প্রতিষ্ঠানেই বিনিয়োগ করা হয়েছে। বাড়তি খরচের ছোঁয়া আমাদের পুঁজির ওপর আসেনি। বহুজাতিক কোম্পানি হওয়ার ব্যবস্থা আমাদের হয়ে গেছে। অবকাঠামো আমাদের হয়ে গেছে। এখন এই অবকাঠামো কাজে লাগিয়ে আমরা কীভাবে এগিয়ে যেতে পারি, তার ওপর আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে। আগে বাংলাদেশ থেকে অনেক পণ্য আমরা বিদেশে রপ্তানি করেছি। আমাদের পণ্য দেশের বাইরেও সুনাম অর্জন করেছে। এখন আমাদের লক্ষ্য বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের বিনিয়োগে কারখানা স্থাপন করা।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : কোন দেশে প্রথম কারখানা স্থাপন করতে যাচ্ছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ?

আহসান খান চৌধুরী : বর্তমানে আমরা ১৪৫টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করছি। এর মধ্যে যদি আমরা কমপক্ষে ১০টি দেশে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কারখানা স্থাপন করতে পারি, তাহলে আমাদের ব্যবসায়িক পরিমন্ডল আরও বাড়বে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে আমাদের বিদেশি বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের বাইরেও আমরা পুঁজি বিনিয়োগ করতে সক্ষম। সরকারকে সাধুবাদ জানাই যে, তারা আমাদের এই সুযোগ করে দিয়েছেন। আশা করছি, আমরা আমাদের প্রথম কারখানা ভারতে স্থাপন করতে সক্ষম হব। আমরা মনে করি, উৎপাদনের অবকাঠামো পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলেও স্থাপন করতে হবে। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনাদের রপ্তানি পরিসংখ্যান কী?

আহসান খান চৌধুরী : আনুমানিক প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমরা রপ্তানি করছি। আমি মনে করি, এটা আসলে খুব ক্ষুদ্র সংখ্যা। নেসলে অথবা ইউনিলিভার ব্যবসা করে ১০০ বিলিয়ন ডলার। আমাদের বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তি আছে। অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কিন্তু ঘানাতে গিয়ে ফ্যাক্টরি স্থাপন করা সম্ভব নয়। তাদের শ্রমিক কিংবা মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপকরা কিন্তু কখনো নাইজেরিয়ায় পণ্যসামগ্রী নিয়ে কাজ করতে সক্ষম নয়। কারণ এমন জনশক্তির জোগান তাদের নেই। আবার দেখুন স্বল্প আয়ের দেশের মানুষের সঙ্গে ব্যবসা করার জন্য কী কী যোগ্যতা থাকা দরকার এটা আমরা জানি। তাই আমরা এখন যোগ্য। তাই বলা যায়, ৫০০ মিলিয়ন ডলার কেন, এটা ৫০০ বিলিয়ন ডলার হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। জেনে খুশি হবেন, প্রথমবারে মতো আমরা আফ্রিকায় গ্যাসের চুলা পাঠালাম, ফ্যান পাঠালাম ফিজিতে, আফ্রিকার অন্য একটি দেশে আমরা রাইস কুকার পাঠিয়েছি। আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন করছি। এই প্রক্রিয়া চলমান। প্রাণ ইতোমধ্যে ১৪৫টিরও বেশি দেশে পৌঁছে গেছে। আরএফএল পৌঁছে গেছে ৬০টিরও বেশি দেশে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছি। আরও বেশি পণ্য বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে যাবে। ওই সময় আসছে খুব বেশি দেরি নেই, একদিন দেখা যাবে পৃথিবীর সর্বত্রই প্রাণ-আর এফএলের পণ্য পৌঁছে গেছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : চ্যালেঞ্জ কী দেখছেন?

আহসান খান চৌধুরী : আমাদের জাতীয় পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিনিয়ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ যেন আরও বেশি আয় করতে পারে। বর্তমানে ন্যূনতম মজুরিটা বেড়ে গেছে। এতে আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত। আমরা সব সময় চাই আমাদের দেশের মানষের ক্রমবর্ধমান আয় যেন এভাবেই বাড়তে থাকে সব সময়। মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে পণ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে। আমরা কল্পনাও করতে পারব না যে, আগামী দিনের বাংলাদেশে কী কী পণ্যের চাহিদা বাংলাদেশে সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যাপক বড় হয়ে যাবে। একটা সীমাবদ্ধতা হলো আমাদের আরও বেশি রপ্তানিমুখী হতে হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে আরও বেশি চাঙা করতে হবে। আমাদের দেশে এখনো ব্যবসা করা ব্যয়বহুল। ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে আমরা অবশ্যই অনেক ভালো করছি। আমাদের আরও ভালো করতে হলে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার বিষয়ে জোর দিতে হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ব্যবসার খরচ কমাতে আপনার পরামর্শ কী?

আহসান খান চৌধুরী : আমাদের বন্দরগুলো আরও বেশি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। সড়কপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সরকার কাজ করছে। নৌ ও আকাশপথের যোগাযোগ আরও ভালো করতে হবে। আশা করছি ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে রপ্তানি বাড়াতে নদীপথ ব্যবহার করতে পারব। উপমহাদেশের ঐতিহ্য কিন্তু নদী। শুধু ড্রেজিংয়ের অভাবে নাব্য কমে যায়। ড্রেজিংয়ের জন্য আমাদের সরকার ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছে। এই কাজগুলো জীবনমান উন্নয়নের জন্য।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে প্রয়াত আমজাদ খান চৌধুরীর কাছ থেকে কী শিখলেন?

আহসান খান চৌধুরী : প্রাণ-আরএফএল গ্রুপে আমাদের প্রথম যুগের নেতা আমার প্রয়াত পিতা আমজাদ খান চৌধুরী। ১৯৮১ সালে তিনি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তাঁর দেখানো পথেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি আমাদের বড় চিন্তা করতে এবং বড় স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন। বাংলাদেশকে আমাদের ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। বাংলাদেশের মেধাবী মানুষের ওপর আস্থা স্থাপন করতে শিখিয়েছেন। আমাদের আত্মবিশ্বাসী হতে শিখিয়েছেন। আমাকে ত্রিপুরা পাঠিয়েছিলেন যেন সেখানে আমরা ব্যবসা করতে পারি। আমরা কিন্তু ভারতের মাটিতে ব্যবসা শুরু করি ত্রিপুরা থেকেই। এমন করে বিশ্বের অনেক জায়গায় ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা থেকেই তিনি আমাকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতেন। তখন বুঝতাম না যে, কেন বাবা আমাকে আকাশচুম্বী প্রকল্পগুলো দিতেন। আজকে আমি বুঝতে পারি, বাবা যদি ওইভাবে না ভাবতেন, তাহলে বর্তমানে বিশ্বের এতগুলো দেশে আমাদের ব্যবসায়িক প্রসার বৃদ্ধি পেত না। তাই আমি মনে করি, পৃথিবীর বুকে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার এই চিন্তা অলীক নয়; বরং অনেক বেশি বাস্তবসম্মত।